শুহিনুর খাদেম।। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আজও এই জনপদের প্রধান প্রাণশক্তি এবং গৌরবের ইতিহাস। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালনায় সবশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে এটি ছিল বিশুদ্ধ গণযুদ্ধ।
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস চর্চা বলতে গেলে নগর কেন্দ্রিক, এর ধারাবাহিকতায় ক্র্যাক প্লাটুন, অপারেশন জ্যাকপট নামের গেরিলা যুদ্ধ গুলো যেমন আলোচিত, পরিচিত তেমনই প্রশংসিত । এরকমই আরোও একটি বাহিনী আমাদের ছিলো যা এই বাহিনী গুলো থেকে কোন অংশে কম ছিলো না বরং দুর্র্ধষতা আর ক্ষীপ্রতা ছিলো আরও বেশী তীব্র। যার নাম ছিলো “দাস পার্টি” যে পার্টির গৌরবময় ইতিহাস উঠে আসেনি আমাদের নগরকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে।
দাস পার্টি বৃহত্তর সিলেটের ৫ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর টেকেরঘাটের একটি গেরিলা দল। দলটির প্রধান জগতজ্যোতি দাস নামের মাত্র ২২ বছর এর এক তরুণ। এই দাস পার্টিতে সদ্য কিশোর যোদ্ধা যেমন ছিলো,তেমনি ছিলো মধ্যবয়সী যোদ্ধাও। ছিলো অশিক্ষিত খেটে খাওয়া কৃষক, সেই সাথে শিক্ষিত তরুণেরাও। এক যেন এক খাঁটি গণযোদ্ধাদের সম্মেলন।
যুদ্ধকালীন সময় দাস পার্টি তাদের অসীম দক্ষতা,সাহসিকতা ও ক্ষিপ্রতায় হাওড় এলাকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও দেশীয় দালাল,রাজাকারদের পরাস্ত করেছিলো। দলনেতা জগতজ্যোতি দুর্র্ধষ এক যুবক। যার বুকের মাঝে ভয়ের কোন ঠায় ছিলো না বিন্দুমাত্র। মানুষটার পুরো কলিজায় ছিলো গনগনে সাহসের খনি। আর তাইতো যুদ্ধের ময়দানে মাথায় বুলেট বিদ্ধ হবার পরেও এই তরুণ উচ্চারণ করে দুই শব্দের একটিই বাক্য ” আমি যাইগ্যা”! কী অবর্ণনীয় সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ এই ক্ষুদ্র বাক্যটি! যেন বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে যাচ্ছেন কোন মোহনীয় স্থানে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বুকের রক্ত নিংড়ে লড়ে যাওয়া এই বীরযোদ্ধাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেবার ঘোষণা দেয়া হলেও পরবর্তীতে যাঁর ভাগ্যে জুটেছিলো তৃতীয় শ্রেণীর খেতাব “বীর বিক্রম”। কিন্তু কেন এই অসামঞ্জস্যতা তার উত্তর মেলেনি স্বাধীনতার এত বছর পরেও।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় অনন্য সংযোজনঃ
“দাস পার্টির খোঁজে”
লেখকঃ হাসান মোরশেদ
প্রকাশনীঃ ঐতিহ্য।
হাসান মোরশেদ তার ” দাস পার্টির খোঁজে ” বইটিতে এমন অনেক ঘটনার সত্যতা তুলে ধরেছেন অসম সাহসিকতায়। বইটির কাজ করার জন্য স্বশরীরে ঘুরে দেখেছেন দাস পার্টির সব যুদ্ধস্থান, কথা বলেছেন দাস পার্টির জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। জগতজ্যোতির সহযোদ্ধা ইলিয়াস এর স্মৃতিচারণ এর মাধ্যমে জেনেছেন তাদের যুদ্ধের বিবরণ।জানা-অজানা সব যুদ্ধগাথা। পরবর্তীতে সেসব লিপিবদ্ধ হয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। অত্যন্ত পরিশ্রমের এবং সাহসিকতার এই কাজটি করতে গিয়ে নিজেও জড়িয়েছেন অপ্রীতিকর ঝামেলায়। লেখকের প্রতি একজন পাঠক এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রইলো আন্তরিক ধন্যবাদ এবং অজস্র শ্রদ্ধা।
লেখকের মাধ্যমে দাস পার্টির ইতিবৃত্ত জানতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাওয়ার মত আমরা জানতে পারি বেশকিছু মর্মান্তিক গণহত্যা এবং নির্মমতার ইতিহাস। যা এতদিন ছিলো কালের গহ্বরে হারানো, সকলের অজান্তে চাপা পড়ে ছিলো প্রচলিত ইতিহাসের গভীরে।
আমরা জানতে পারি, একটানে কানের লতি ছেঁড়া বীরাঙ্গনা প্রমীলা দাসের কথা। জানতে পারি, ৪৪ বছর যাবত শরীরে আটকে থাকা বুলেট নিয়েই জীবনযাপন করা ব্রজেন্দ্র দাসের কথা। শুধু তাই নয়, ঘাতক রাজাকার এবং তাদের উত্তরসূরিরা যখন ক্ষমতার জোরে বীরাঙ্গণা কুলসুম বিবিকে “নটি বেটি” বলে ডাকে, মুক্তিযোদ্ধা নিরানন্দ দাসকে জুতাপেটা করে তখন তা পড়তে পড়তে শরীর শিউরে ওঠে।
বইটি পড়ার সময় মাথায় আগুনের দপদপানি অনুভব করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা ইতিহাসের অকাট্য দলিল এই বই ” দাস পার্টির খোঁজে “।
সহযোদ্ধা ইলিয়াসের বুকে গুলি লাগার পরে দলনেতা জগতজ্যোতি দাস বলেছিলেন, “বাঁচবি?”
ইলিয়াসের উত্তর ছিলো, ” বাঁচতে পারি।”
সেই জীবন মৃত্যুর অন্তিম পর্যায়েও জগতজ্যোতির আদেশ ছিলো, ” তাহলে যুদ্ধ কর “।
আজকের প্রজন্মের একজন হিসেবে যা পড়ার পর অবাক হয়ে ভাবি কতটুকু জানি আমরা ৭১ কে?
অথচ স্বাধীনতার এই মহান আত্মত্যাগের সংগ্রামকে আমরা ঘোষক আর পাঠকের মধ্যেই বেধে রেখে উপস্থাপন করছি প্রজন্মের কাছে। যেন এর বাহিরে আর কোনো ইতিহাস নেই! যে মানুষ গুলো বুকের তাজা রক্ত, সম্ভ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা, আজ স্বাধীন দেশে তাদের বেড়ার ঘর, দু মুঠো অন্নের জন্য অমানুষিক পরিশ্রম এবং দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে স্তব্ধ হয়ে ভাবতে হয় – এ দায় কার? আমরা অকৃজ্ঞ, আমরা বেঈমান। জাতির বীর যোদ্ধারা যেখানে প্রাপ্য সম্মান পায়নি,সেখানে সেই জাতি কীভাবে সম্মানের জীবন পাবে? হায় স্বাধীনতার এ কী অবমাননা! যাদের যা প্রাপ্য তা দিতে পারিনি বরং ক্ষমতায় এসেছে সেসব দালালেরা যারা চায়নি আমাদের স্বাধীনতা!
সর্বোপরি দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিক এর দায়িত্ব অকাট্য সত্যতা তুলে ধরা এই বইটি পড়া ।
সংযোজনঃ
জগৎজ্যোতি দাস হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জীতেন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র। স্কুল জীবনেই জগৎজ্যোতি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে অনেকগুলো অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ত করেন এবং ধীরে ধীরে নকশালপন্থীদের সঙ্গে জড়িত হন। এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।
লাল সেলাম হাওর বাংলার চে জগতজ্যোতি । স্বার্থক হোক তোমার আত্মদান।
লেখক। ব্যাংক কর্মকর্তা