আশরাফুল ইসলাম।। অসখ্য লোকগানের রচয়িতা, সুরকার ও আধ্যাত্মিক সাধক হাসন রাজার ৯৮তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর এই মরমি কবি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সুফি সাধকগণ তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন।
বাংলার দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে এ মরমী সাধক। তাঁর মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্ এর প্রধান পথিকৃৎ। এর পাশাপাশি নাম করতে হয় ইবরাহীম তশ্না দুদ্দু শাহ্, পাঞ্জ শাহ্, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ্, শিতালং শাহ, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।
অহিদুর রেজা বা দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী বা জনপ্রিয় হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে।
হাছন রাজা ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তার তৃতীয় পুত্র। আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম।
হাছনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তার অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তারই নামের আকারে তার নামকরণ করেন অহিদুর রাজা। হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
জানা যায়, হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।
হাছন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্মিক স্বপ্ন-দর্শন হাছন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাছন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তার চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন।
শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এভাবে- ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন, সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন’।
হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ‘হাছন উদাস’ গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
শোনা যায়, হাছন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয়-‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,’মরমী কবি হাসন রাজা’)। ‘হাছন বাহার’ নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত। ঈশ্বানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তার গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও নিজেকে দীনহীন বিবেচনা করেছেন, আবার তিনি যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে বাঁধা ঘুড়ি সে কথাও ব্যক্ত হয়েছে এমন গানে- “গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি। হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি। মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা। জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসন রাজাকে চিনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাছন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তার দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি ‘Modern Review’ (জানুয়ারি ১৯২৬) পত্রিকায় ‘The philosophy of our People’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ (মাঘ ১৩২২) পত্রিকায়। ভাষণে হাছন রাজা সম্পর্কে কবিগুরু বলেন- “পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির (হাছন রাজা) গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-
“মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।”
হাসন রাজার গবেষণা-সাধনা ও শিল্পকর্ম ছিল গণ-কল্যাণমুখী। তিনি বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। আবার সুরের সাধকও ছিলেন। তার চিন্তা চেতনায় আবহমান বাংলার কৃষ্টি শিল্প সংস্কৃতি ধারণ করে বাংলার গৌরবকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
হাসন রাজার গানে সহজ সরল স্বাভাবিক ভাষায় মানবতার চিরন্তন বাণী যেমন উচ্চারিত হয়েছিল, তেমনি আধ্যাত্মিক কবিও ছিলেন তিনি। সকল ধর্মের বিভেদ অতিক্রম করে তিনি গেয়েছেন মাটি ও মানুষের গান।
মাটি ও মানুষের অমর কবি ও সাধক হাসন রাজার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসুত্র। সংগ্রহ।