আশরাফুল ইসলাম।। শৈশবে শুনতাম, কৈশোরে মিছিলে গলা ফাটাতাম- “মুজিব হত্যার পরিণাম, বাঙলা হবে ভিয়েতনাম”। কথাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকারীদের ফাসির রায় কার্যকর হবার আগে পর্যন্ত আমাদের মিছিলের প্রধান শ্লোগান-ভাষা ছিলো। মুজিব হত্যার বিচারের দাবীতে ওই শ্লোগান ছিল উম্মাদনাদায়ী শব্দমালা। বাসার সামনে রাস্তায় চলে যাওয়া যুবক-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ’র যৌথমিছিল থেকে প্রথম শুনতে পাই- ‘মুজিব’ ‘ভিয়েতনাম’ শব্দগুলো। আমার কৌতুহল আমাকে শেখায়- মুজিব মানে বাংলাদেশ, মুজিব মানে আমি।
এরপর বুঝেছি- ভিয়েতনাম মানে, নিজের অস্তিত্ব ও দেশের স্বাধীনতার জন্য এক জীবনবাজী রাখা মুক্তিকামী জীবন-জুয়ারীর নাম। ভিয়েতনাম, বলতে গেলে নিজেদের লাঠিসোটা দিয়ে আমেরিকার রাইফেল-ট্যাংক-যুদ্ধবিমানসহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রকে কাবু করে দিয়েছিলো, মার্কিনীদের তাড়িয়ে দেয়, পালাতে বাধ্য করেছিলো বিশ্ব সন্ত্রাসের জনক আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রকে।
“ মুজিব হত্যার পরিণাম, বাঙলা হবে ভিয়েতনাম”-র মানে জানাশুনার পর, একসময় আমার কন্ঠ দিয়েও আপনাআপনি বেরিয়ে আসতো কবিতার মতো শ্লোগানটি। পরবর্তীতে, আরও অনেক কবিতাময় শ্লোগানে কোরাস করতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভায় মিছিলে – মুজিবের বাংলায়, খুনীদের ঠাই নাই; ‘এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব মিছিল করে’ ‘মুজিব মানে মুক্তি, মুজিব আমার যুক্তি’-র মত শ্লোগানের কবিতাগুচ্ছ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়ও ছিলো স্বাধীনতা, মুজিব, সামরিক বাহিনী ও রাজনীতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তি, ভিয়েতনাম, চীন, কিউবা, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, জাতিসংঘ, এনজিও সংঘ ইত্যাদি। জেনেছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একা পাকিস্তান পরাজিত হয়নি, সাথে পরাজিত হয়েছে চীন, আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদের দোসরেরা।
তাই বলা যায়, দৃশ্যত: ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করলেও ওই চীন-আমেরিকা জুটির একমাত্র মিশন ছিলো শেখ মুজিবকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে বাংলাদেশের দায়িত্ব তুলে দেওয়া, বা একটা পুতুল সরকার স্থাপন করা।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে মুজিব হত্যার পর সৌদি আরব, লিবিয়া ইত্যাদি দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। মুজিব এর বাংলাদেশ মেনে নেয়নি আমেরিকার ওই দুষ্টচক্র।
ভারত-রাশিয়া লাইনের, ফিদেল-টিটো মনস্ক শেখ মুজিব সাম্রাজ্যবাদীদের দোকানদার হবার নয়, হননি। এছাড়াও, হেনস্থা করতে বাংলাদেশকে চুষে-নিংড়ে নিতে, বাংলাদেশ থেকে মুজিবকে সরানোই ছিল একাত্তরে পরাজিতদের তৎকালের একমাত্র মিশন।
বিশ্বের দেশগুলোকে সোমালিয়া, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো বানিয়ে দেওয়া আমেরিকা-দুষ্টচক্রের বিশ্ববাণিজ্যের প্রধান ভিত্তি। বাংলাদেশের প্রতিশব্দসম শেখ মুজিব স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরনে বাজারবিরোধী পদক্ষেপ নিতে থাকেন। দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা ফিরিয়ে আনতেই তৎকালীন যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
মুজিবের উক্ত উদারতা যে কাল হয়ে দাড়িয়ে ছিল তা বেঘোরে জীবন দিয়েও বুঝে যেতে পারেননি শেখ মুজিব।
বলাবাহুল্য, আগস্টের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ভারতের তৎসময়ের অর্থাৎ ১৯৭৫-এ কর্মরত হাই কমিশনার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে, ১৫ আগস্টের মত মর্মান্তিক ঘটনার সম্ভাব্য আশংকার গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েও ছিলেন। জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ও স্বভাবসূলভ অগাধ ভালোবাসার কারনে তিনি ওই প্রতিবেদনের আশংকাকে আমলে নেননি। বরং ওই হাইকমিশনারের সাথে রসিকতা করেন এবং তাঁকে না কি কই মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানান।
এরপর, বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস্যের ইতিহাস। শেখ মুজিব কে হত্যার উদ্দেশ্য সফল করতে বেশী সময় লাগেনি হত্যাকারী চক্রটির।
তারপরও থেমে থাকেনি বাঙলা বিরোধী চক্রটি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার শাসনকালে দেশী বিদেশী চক্র যা যেভাবে পেরেছে তা নিয়ে একাত্তরে তাঁদের পরাজয় ও অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে।
যাই হোক, একসময়য় মুজিব ও বাংলাদেশ- বিরোধী চক্রটির ক্ষমতায় ভাটা আসে। অনেক পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সক্ষম হয়।
২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার ও দলকে জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে যথাসম্ভব সম্পৃক্ত ও নিয়ন্ত্রনে রাখতে পেরেছিল।
২০০১-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভে ব্যর্থ হয়ে ৮ বছর রাষ্ট্রীয়- ক্ষমতার বাইরে ছিল। যেজন্য, বাংলাদেশকে গুছিয়ে তুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তবে, ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং আজ পর্যন্ত টানা তৃতীয় মেয়াদে আছে।
তাই, এখন প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কি কোন না কোন ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম হতে পেরেছে? বরং ২০১৮ সালে জুলাই মাসে ‘ নিরাপদ সড়কের দাবীতে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনে উচ্চারিত নির্লজ্জ নোংরামি ও বখাটেপনায় পূর্ণ ভাষা কি ভিয়েতনামের বিপ্লবমুখী চেতনার বিপরীতে অবস্থান নয়?
তাহলে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
[ চলবে]