আরণ্যক আচার্য।। ছাগল, কখনোই বলদের মতো লাঙ্গল টানতে পারে না। কাক কখনোই কোকিলের মতো কুহু- কুহু গাইতে পারে না।
না, না– না বাচক। প্রকৃতির সবই তবে ঋণাত্মক? নেতিবাচক?
কিন্তু, প্রকৃতির দিকে চোখ রাখলে দেখি, প্রাণীরা যা পারে না, তারা তা পারে না। এমনকি তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথাও নেই। মানুষও তো জীবজগতের এক প্রাণী। অথচ সে যখন কোনো কাজ পারে না, সে ভাবে কেনো হলো না, কেনো হতে পারে না। হতেই হবে, করতেই হবে, হবে হবে, পারবো, পারবো । আর এই চিন্তা ধারাকে বলা হয় পজিটিভ থট। ইতিবাচক চিন্তাধারা।
আর মানুষের চিন্তা ধারার সেই অদম্য পজিটিভ শক্তিই মানব সভ্যতাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। মানুষ তার শক্তিকে, গতিকে নানা ভাবে শুধু বাড়িয়েই গেছে, বাড়িয়েই যাচ্ছে।
আমাদের জীবনে দেখা গত কয়েক দশক ধরে মানুষের চিন্তাধারার সেই পজিটিভ শক্তির নমুনা দেখে মানুষ নিজেই হতবাক হয়ে যায়। গত কয়েক দশক জুড়ে মানুষ তার মেকানিক্যাল শক্তিকে বাড়ানোর কাজ করে গেছে। ইন্ডাস্ট্রি গঠন, ম্যানুফ্যাকচারিং করে গেছে।
আজ মানুষ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে মেশিন মানুষের শারীরিক শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে। এবার মানুষ চায়– তার মস্তিষ্কের শক্তি, চিন্তা করার সেই আশ্চর্য ক্ষমতাকেও মেশিন ছাপিয়ে যাক। আর সেই ছাপিয়ে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের শিখিয়েছে– থিঙ্ক পজিটিভ, বি পজিটিভ, এগোতে আমাদের হবেই, আমরা পারবো। আর এতে আমাদের সভ্যতার রথ রকেট হয়ে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু, এতো কিছুর পরে একটা প্রশ্ন যে রয়েই যায়। সব সময়ই পজিটিভ থিঙ্কিং কি ভালো? বোদ্ধারা সকলেই বলেন পজিটিভ থিঙ্কিং করা উচিত। সত্যি কি তাই?
এই প্রসঙ্গে ধরুন- একটা দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় রাতে যাত্রী বাহী বাস চলাচল করে। নাইট সুপার বলে। এমন একটি নাইট সুপার এক বাস যাত্রী নিয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছিলো। পাশে খাদ ও আঁকাবাঁকা রাস্তা। শীতের আমাবশ্যা রাতের ঘন অন্ধকার চারিদিক আছন্ন করে দিয়েছিলো, একটু দূরের জিনিসও কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।
সাধারণত রাতের বাসগুলো দল বেঁধে যাতায়াত করে, এক একটা বাসের পিছনে আরেকটা বাস চলে। কারণ রাস্তায় মাঝে মধ্যে ডাকাতিও হয়।
যা হোক, সেই বাসটি কিভাবে যেনো দল ছুট হয়ে গিয়েছিলো। সেই বাসের ড্রাইভারটি পাহাড়ি পথে নতুন। পাহাড়ি পথে গাড়ি চালাতে অনভিজ্ঞ ড্রাইভার তাই সন্তর্পণে চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু, ওর গাড়ি চালানোর ক্ষমতা নিয়ে ওর নিজের মধ্যে তো কোন প্রশ্ন ছিল না, সে ছিল পজিটিভ। শিলঙ্গের পাহাড়ি পথ মানে, পাহাড় শ্রেণীর মধ্যে পাহাড়ের গায়ে গায়ে আঁকাবাঁকা পথ, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে গাড়ি চলাচল করে।
এক পাশে খাড়া পাহাড় ও অন্য পাশে গভীর খাদের মধ্যে ঘন জঙ্গল, আর সেই জংলি অন্ধকার পথে গাড়ি চলাচল করা যথেষ্ট বিপজ্জনক। হঠাৎ-ই গাড়ির চালক দূরে এক গাড়ির হেড লাইট দেখতে পায়। চালক ভাবে, ঐ তো পথ। সে দূরের হেডলাইট টার্গেট করে সিধে চালিয়ে দেয়।
আসলে, দূরের ঐ গাড়ির হেড লাইট, যা সে দেখতে পেয়েছিলো– তা ছিল অন্য পাহাড়ি রাস্তার বাঁকের আলো। দূর পাহাড় থেকে সেই আলো একদম সরল রেখায়, সিধে আসছিল। কিন্তু, মাঝে যে ছিল খাদ, অন্ধকারে তা একদম বোঝা যায় না। আর সেই যাত্রীবাহী বাস সরাসরি গিয়ে পড়েছিলো খাদে। সেই দিন, সেই ড্রাইভারের অভিজ্ঞতাহীন চিন্তাধারা বহু মানুষের বিপদ ডেকে এনেছিলো।
তাই মাঝে মাঝে মনে হয় – অভিজ্ঞতাহীন, বিবেচনাহীন পজিটিভ থিঙ্কিং কি সবসময় ভালো? নাকি জীবনে কখনো কখনো নেগেটিভ চিন্তাধারার প্রয়োজন আছে? একটা সময়ে – না, পারবো না, হতে পারে না – মেনে নেওয়াও কি ভালো নয়?
কিন্তু, কেউ বলেন, তাহলে কি চেষ্টা করা ছেড়ে দেবো? আরে না না, চেষ্টা ও চিন্তা– দু’টো কিন্তু একদম আলাদা আলাদা বিষয়। চেষ্টা মানে কর্ম, চেষ্টাবিহীন শুধু পজিটিভ থিঙ্কিং মানে তো শুধুই এক বিমূর্ত ভাবনা। চেষ্টা মানে, কোন এক কাজ। মানুষ জানে কাজটা কঠিন, সে পারবে, কিংবা পারবে না। সাফল্যের সম্ভাবনা ফিফটি- ফিফটি।
কিন্তু, পজিটিভ থিঙ্কিং মানে তো একশোতে একশো শতাংশ। আর মানুষ যখন কল্পনায় ভাবে, তখন পুরো একশো শতাংশই ভাবে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে কাজ হয় দশ শতাংশ। তাহলে, হতাশা তো আসেই, আসে মন খারাপ, দুঃখ, বিষণ্ণতা, ডিপ্রেশন ইত্যাদি। তাহলে? উপায়?
আসলে, মনে হয়, জীবন মানে তো শুধুই পজিটিভ হতে পারে না। খাদের ধারে যে গাড়ি চালায়, তাকে তো পজিটিভ, নেগেটিভ, অভিজ্ঞতা, উপদেশ, পথের খবর, কি আছে শেষে, সব কিছু সঞ্চয় করে নিয়েই গাড়ি চালাতে হয়। শক্তি সামর্থ্যও এনালাইসিস করতে হয়। পায়ে পায়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হয়। আর সেই কথাটাই আমরা বুঝে উঠতে অনেক সময় নিয়ে ফেলি। ততক্ষণে প্রায়ই খাদে পড়ার অবস্থা হয়।
দূরের আলো দেখে ভাবি- সোজা পথ। কিন্তু, জীবনপথ যে বহু বাঁকে, বহু চড়াই উৎরাইয়ে পূর্ণ। ইন্ডাস্ট্রি এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এর আশীর্বাদে কাল্পনিক- অতিকাল্পনিক অভিজ্ঞতা থেকে ‘বি পজিটিভ’ শ্লোগান ধারণ করা বা সবকিছুর ভালো দিকটা দেখা ছাড়া উপায় নেই। বুঝতে হবে- পৃথিবীসমগ্র জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তিক্তাতিরিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পাশাপাশি জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা কম ভাগ্যের বিষয় না। বেঁচে থাকার কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে শুরু হোক- বিয়িং পজিটিভ।
অবাক পৃথিবী