মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম।। আজ ১৮জানুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, ৪ মাঘ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। সকালবেলা কুয়াশা চাদরে চারদিক আবৃত। কুয়াশা ভেদ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সঙ্গে গ্রামবাংলার রুবেল তালুকদার।
চলতে চলতেই কুয়াশা কেটে গেল। মমিনপুরের পাশ দিয়ে যেতেই দেখলাম ছোটখাটো দিঘির পাশেই মহীরুহের মত চালতা গাছ যেন জলের দিকে হেলান দিয়ে আছে। শাইলগাছের রাস্তার দু’পাশে তালগাছের বিশাল সমারোহ, মাঝে মাঝে খেজুর গাছ আছে অজস্র।
পথিমধ্যে স্থানীয় হাবিবপুর এর আব্দুল আউয়াল জানালেন হাজী আব্দুল খালেক অনেক তাল গাছ লাগিয়েছেন আর কৃষকরা তাদের জমির পাশে তালের বীজ রোপন করাতে এতো তাল গাছের সমারোহ। খেজুর গাছগুলো এমনি এমনি বেড়ে উঠেছে।
পাইকুড়া, পাট্টা শরীফ ও এখতিয়ার পুর পেরিয়ে শাকির মোহাম্মদ বাজারের জনসমাগম এড়িয়ে, মজলিশপুর বন্ধু সারওয়ারের বাড়িতে। বন্ধুর পিতা বন কর্মকর্তা তোফাজ্জল হক তরফদার ও বড় ভাই মামুন তরফদারের সাথে দেখা হলো। ভাতিজি লিখা চমৎকার চা দিয়ে আপ্যায়ন করলো।
তারপর সাদেকপুর হয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল মির্জাপুর পুলিশ বাড়ির যুবকদের উদ্যোগে পাক পাঞ্জাতন স্মরণে তৃতীয় বার্ষিকী সুন্নি মহা সম্মেলনের বিশাল প্যান্ডেল। অনেকগুলো তোরণ। নামকরা ওয়াজিয়ানরা আসবেন, আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো।
দক্ষিণ গোড়ামি পার হয়ে মহিমাউড়া প্রান্তর ছাড়িয়ে ডেউয়াতলী বাজার ও ডেউয়াতলী আউলিয়া বাজার। তারপর কালিনগর মেম্বার ত্রিমুহনা বাজার হয়ে পানছড়ি গুচ্ছগ্রামের দিকে এগোতেই প্রকাণ্ড বাঁশ বাগানের দীর্ঘ ছায়ায় শরীরে নিয়ে এলো সতেজতা।
শ্রীহীন গুচ্ছগ্রামে নেই কোন সবজি বাগান, নেই কোন ফুলের বাগান, মানুষগুলো শুধু বেঁচে আছে। পাশে গড়ে উঠেছে পানছড়ি আশ্রায়ন প্রকল্প। বিশটি টিনের ঘর ও বন্ধু চুলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে ছিন্নমূল মানুষের কাছে।
ছবিঃ পানছড়ি আশ্রায়ন।
অনেককে জিজ্ঞেস করলাম কেন তারা এখানে এলো? তাদের কি বাড়িঘর নেই? তারা বললেন, দীর্ঘদিন আশ্রয়হীন অবস্থায় মানুষের বাড়িতে মাথাগোঁজার ঠাঁই কখনো কখনো হয়েছে, কখনো হয় নি। এখানে এসে জীবনের নিরাপত্তা তারা পেয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে এখানে প্রকট পানির সমস্যা ও বিদ্যুৎহীন জীবন। তারা জানালেন অচিরেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।
পাশেই জমিতে ফুলের চাষের জন্য তৈরি হচ্ছে। বিশাল মাঠে শিশু-কিশোররা খেলছে। একদল শিশুর হাতে লাঠি আর বল, বুঝলাম তারা তাদের মতো করে হকি খেলছে।
সেখান থেকে চললাম সরকারি উদ্যোগে নির্মাণাধীন পানছড়ি রিসোর্টের দিকে। পাক পাঞ্জাতন মোকাম দেখে, অচেনা মানুষের কৌতুহলী চোখের স্পর্শের ছোঁয়ায় চাঁনপুর টু শাহপুর রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। ডান পাশে নির্মাণাধীন পানছড়ি রিসোর্টে।
ছবিঃ নির্মাণাধীন সরোবর।
বিশাল এলাকা নিয়ে এই রিসোর্টের অবকাঠামো গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। চমৎকার একটি সরোবর নির্মাণ করা হচ্ছে। তিন স্তরের গভীর এই সরোবরে জল ফিরোজা রঙের।
ছোট্ট শিশু নিরবকে বললাম, পানির রং এমন কেন? সে বলল আকাশের রঙের মতো, আকাশের ছায়া পড়লেই জলের রং এমন হয়।
কিছু শিশু-কিশোর কাঁধে বেতফল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। কিছু ফল নিয়ে খেলাম।
তারপর এখানে খানিক বসে অচেনা দুটি পাখির চমৎকার সংগীতে মুগ্ধ হয়ে আবার রওনা দিলাম ফেরার উদ্যেশ্যে।
দেওন্দি চা বাগানের প্রান্ত থেকে রঘুনন্দন বাগান ঘেঁষে দেওন্দি চা বাগানের ফ্যাক্টরি হয়ে, শৈশবে রাব্বি ভাই ও রঞ্জনদাদাদের কোয়ার্টার দেখার ইচ্ছা নিয়ে এগোতে শুরু করলাম। কখন যে বাসাগুলো পেরিয়ে আসলাম বুঝতে পারেনি। একজন চা শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, ওই যে তিনটি কোয়ার্টার সেগুলোই তো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
তখন সেই কোয়ার্টারগুলোর সামনের রাস্তা ছিল বিস্তৃত। অনেক বড় লাল নুড়িপাথর ছড়ানো ছড়ানো বিশাল রাস্তায় বিয়ারিংয়ের গাড়ি ও বাইসাইকেল চালাতাম। কালক্রমে রাস্তা ছোট হয়ে আসছে, ট্রাকর চলাচলের জন্য দুই পাশে ইটের সলিং করা হয়েছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আর ভাবলাম, ৪০ বছরে এটুকু বিবর্তনতো হবেই।
সেখান থেকে আবার ছুটলাম গিলানি ও লস্করপুর চা বাগানের পথ ধরে। পৌষ সংক্রান্তির কারণে শ্রমিকদের মাটির ঘর ও আঙ্গিনা পরিচ্ছন্ন এবং আলপনা আঁকা, যা আমাদের মুগ্ধ করেছে। বেগম খান হয়ে চাঁনপুর বাগানের পাশ দিয়ে আবার বাড়িতে- ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে।
লেখক। সহকারী অধ্যাপক।
ইতিহাস বিভাগ। লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ।